প্রসূন মুখোপাধ্যায়, পশ্চিম মেদিনীপুর (শালবনি): ক্লাস সামলানো থেকে মিড-ডে মিলের (Mid Day Meal) বাজার, আদিবাসী অধ্যুষিত শালবনিতে (shalboni ) ‘সবেধন নীলমণি’ একমাত্র দিদিমণিই! পশ্চিম মেদিনীপুরের (West Midnapore) ২২৭টি স্কুলে একজন শিক্ষক, কি জানালেন চেয়ারম্যান? বাংলার শিক্ষা পোর্টালের (Bangla Shikhsa Portal) তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের দু’হাজারের বেশি (২২১৫) প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক-শূন্য অথবা ওই স্কুলে একজন মাত্র শিক্ষক রয়েছেন।
সম্প্রতি, রাজ্যের শিক্ষা দফতর সূত্রেই এই পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে এসেছে। সেইসঙ্গেই শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ বা ডিপিএসসি-র চেয়ারম্যানদের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই ধরনের স্কুলের সংখ্যাটা দু’শোর বেশি (২২৭)। আর এই স্কুলগুলির মধ্যেই অন্যতম সদর উত্তর চক্রের অধীন শালবনি ব্লকের হিরাডিহী-পাথরচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (Hiradihi-Patharchati Primary School) । এই স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বর্তমানে ৩৬। তবে, ‘সবেধন নীলমণি’ শিক্ষিকা একজনই! তিনিই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর একার ঘাড়েই প্রাক-প্রাথমিক (প্রি-প্রাইমারি) থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি ক্লাস সামলানো, মিড-ডে মিলের তদারকি করা এবং অন্যান্য অফিসিয়াল কাজের দায়িত্ব! কার্যত হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষিকা মধুমিতা সাহা (Teacher Madhumita Saha) ।
আরও পড়ুন- পুজোর প্রসাদে বিষক্রিয়া! অসুস্থ ৪০ জন
মঙ্গলবার নিজের স্কুলে দাঁড়িয়ে তিনি জানিয়েছেন, “আরেকজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি চলতি বছরের মার্চ মাসে অবসর নিয়েছেন। তারপর থেকে আমাকেই সবটা সামলাতে হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, একটি স্কুল চালানোর জন্য কমপক্ষে দু’জন শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রয়োজন। আর আমাদের বিদ্যালয়ে যেহেতু ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩৬ (তিরিশের বেশি)। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দু’জন শিক্ষকের প্রয়োজন।” তিনি এও বলেন, “একার পক্ষে পাঁচটি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো, মিড-ডে মিলের বাজার করা, সমস্ত অফিসিয়াল কাজ সামলানো সত্যিই মুশকিল!”
মধুমিতা জানিয়েছেন, শালবনির এই প্রান্তিক এলাকাটি (হিরাডিহী) আদিবাসী অধ্যুষিত। স্কুলের ৩৬ জন ছাত্রছাত্রীই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। গ্রামের পরিবেশও শান্ত-নিরিবিলি। তবে, পিছিয়ে পড়া এই এলাকার পড়ুয়াদের পঠনপাঠনের বিষয়টি দায়িত্ব সহকারেই সামলাতে হয়। ঠিক তেমনই প্রতিদিন সঠিকভাবে মিড-ডে মিল পরিচালনাও করতে হয়। সবথেকে বড় কথা, তিনিই স্কুলের একমাত্র শিক্ষিকা হওয়ায়, কোনদিন তিনি সমস্যায় পড়লে স্কুলের পঠনপাঠন থেকে মিড-ডে মিল কার্যত ‘বন্ধ’ হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং সচেতন নাগরিকদের মতে, শহর ও মফস্বল এলাকায় যেখানে একের পর এক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা ‘উদ্বৃত্ত’ বা ‘সারপ্লাস’ (ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা বেশি); সেখানে এই সমস্ত প্রত্যন্ত এলাকায় একজন বা দু’জন শিক্ষক শিক্ষিকা দিয়ে স্কুল চালাতে হচ্ছে! এটা শিক্ষার অধিকার আইনকেও লঙ্ঘন করছে।
শাসকদলেরই শিক্ষক সংগঠনের তরফে জানা গেছে, শালবনি ব্লকের সদর উত্তর চক্রেই প্রায় ৩০-৩৫টি স্কুলে উদ্বৃত্ত শিক্ষক রয়েছেন। যেকোন একটি স্কুল থেকে আপাতত লোকাল অ্যারেঞ্জমেন্টের মাধ্যমে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে ওই স্কুলে পাঠানোই যায়।
হিরাডিহী-পাথরাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মধুমিতা সাহা (Acting Headmistress Madhumita Saha) বলেন, “তাঁদের স্কুলের বিষয়টি অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক (এসআই) জানেন। ডিপিএসসি-র চেয়ারম্যানকেও জানানো হয়েছে। তাঁরা বিষয়টি দেখছেন বলে জানিয়েছেন।”
পশ্চিম মেদিনীপুর ডিপিএসসি-র চেয়ারম্যান অনিমেষ দে বলেন, “নিয়মেই বলা আছে, যত কম ছাত্র সংখ্যাই হোক না কেন, একটি স্কুলে কমপক্ষে দু’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রয়োজন। সেই নিয়ম মেনেই যে সমস্ত স্কুলে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা (সিঙ্গেল টিচার) ছিলেন, আমরা সেখানে লোকাল অ্যারেঞ্জমেন্টের (অস্থায়ীভাবে) মাধ্যমে হলেও, আরেকজন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পাঠিয়েছি। হিরাডিহী-পাথরাচাটি স্কুলের ক্ষেত্রেও দ্রুত একজন শিক্ষক (বা, শিক্ষিকা)-কে পাঠানো হবে।”
যদিও, মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মধুমিতা দেবী একাই স্কুল সামলেছেন। শালবনির একটি স্কুলের শিক্ষক তথা শাসকদলের শিক্ষক সংগঠনের অন্যতম প্রতিনিধি তন্ময় সিংহ বলেন, “যে সমস্ত স্কুলে উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) শিক্ষক রয়েছেন, সেখান থেকে অবিলম্বে এই ধরনের স্কুলগুলিতে শিক্ষকদের বদলি করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে শিক্ষা দপ্তরও সবুজ সংকেত দিয়েছেন।”
ডিপিএসসি-র চেয়ারম্যান অনিমেষ দে-ও অবশ্য এই সংক্রান্ত ‘সুখবর’ শুনিয়েছেন।
কলকাতাটিভি-কে তিনি জানিয়েছেন, “জেলার যে সমস্ত স্কুলে ১ জন শিক্ষক ছিলেন, সেখানে আমরা লোকাল অ্যারেঞ্জমেন্টের মাধ্যমে আরেকজন শিক্ষককে পাঠিয়েছি। তাঁরা সম্মতি দিলে, ওই স্কুলেই তাঁকে স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত (বদলি) করা হবে।”
দেখুন আরও খবর-